সাইফুল ইসলাম:
নিজেকে পুড়িয়ে নানা ঘাত-প্রতিঘাত সয়ে একজন মানুষ স্থান করে নেয় ইতিহাসের পাতায়। তেমনি একটি নাম ঢাকার নবাবগঞ্জের কৃতি সন্তান মরহুম আনিছ উদ্দিন আহমেদ ওরফে আনিছ মাস্টার। মরহুম আনিস উদ্দিন আহমেদ শুধু একটি নাম নয়, নবাবগঞ্জের খানেপুরের একটি গৌরব উজ্জ্বল ইতিহাস। শত চড়াই-উতরাই পার করে যিনি মানুষের কল্যাণে কাজ করেছেন। আজ আনিছ মাস্টারের ৭ম মৃত্যু বার্ষিকি। আনিছ মাস্টার সবসময় শিক্ষার আলোয় মানুষকে আলোকিত করতে পরিশ্রম করেছেন অক্লান্ত। সবসময় নিজ এলাকার মানুষের কথা ভেবেছেন, তাদের উন্নয়নের কথা ভেবেছেন। সমাজে পিছিয়ে পড়া মানুষদের সামনে আনতে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। তিনি আরেকবার প্রমান করে গিয়েছেন মানুষ বয়সে নয়, বেঁচে থাকে তার কর্মে। তেমনি আনিছ মাস্টার খানেপুরবাসীর কাছে বেঁচে থাকবে চিরকাল।
নবাবগঞ্জের নয়নশ্রী ইউনিয়নের ইছামতি নদীর কূল ঘেষা খানেপুর গ্রামেই এই মহান ব্যাক্তির জন্ম। খানেপুর গ্রামের ব্যবসায়ী রাজিউদ্দিন আহমেদ ও ছবিয়া বেগমের আট সন্তানের মধ্যে সপ্তম সন্তান ছিলেন তিনি। শিশু বয়সেই মাকে এবং কৈশোরের শুরুতে বাবাকে হারান আনিছ মাস্টার। জীবন চলা শুরু হয় সরু কাঁচের রাস্তার উপর দিয়ে চলার মতো। তখন বাবার ব্যবসার হাল ধরেও ছেড়ে দেন। ১৯৬৮ সালে এইচএসসি এবং ১৯৭০ সালে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের শেষ ব্যাজে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন মানিকগঞ্জের দেবেন্দ্র কলেজ থেকে। এম এ ডিগ্রী লাভ করেন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ব্যাজের ১৯৭৪ সালে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। সে সময় তিনি বেশ কয়েকটি উচ্চপদস্থ পদে চাকুরির সুযোগ পেয়েও করেন নি। কারন তার ছোট বেলা থেকেই স্বপ্ন ছিলো তার নিজ গ্রামের মানুষের জন্য কিছু করা। তার নিজ গ্রাম খানেপুরসহ সেসময় আশেপাশের কয়েকটি গ্রামে শিক্ষার আলো তেমন পৌঁছায় নি। তখন দরিদ্র পরিবারের শিশুদের লেখা পড়ার সুযোগ তেমন ছিলো না। কেউ তাদেরকে নিয়ে একবারও ভাবেনি। কিন্তু আনিছ মাস্টার শৈশব থেকেই ভেবেছেন কী করে শিক্ষা বঞ্চিত শিশুদের শিক্ষার আলোয় আলোকিত করা যায়। তার নিজ এলাকায় একটি স্কুল তৈরি করা তার স্বপ্ন ছিলো সেই ছোট থেকেই। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৬৭ সালে এলাকার জনসাধারণের সহায়তায় ‘খানেপুর আলালপুর জুনিয়র হাই স্কুল’ একটি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। কিন্তু দুই এলাকার মানুষের মাঝে মিলের অভাবে তা বাস্তবায়নে সম্ভব হয়নি। আনিছ মাস্টার প্রথমবার স্কুল প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হলেও স্বপ্ন দেখা ও চেষ্টা বন্ধ করে নি। এর পরে ১৯৭৬ সালে মানুষের দ্বারে দ্বারে গিয়ে একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রয়োজনীয়তা বুঝিয়েছেন। একটি সভা করে আনুষ্ঠানিক ভাবে ‘ কান্দা খানেপুর আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠার ঘোষনা দেন। বিদ্যালয়ের হাল ধরেন নিজেই। সম্পুর্ন সহযোগিতা করনে তার সহধর্মিণী, ভ্রাতৃবধূ, ভ্রাতুষ্পুত্রবধূ সহ পরিবারের সবাই।
প্রথম দিকে শিক্ষা অফিসের অনুমতিক্রমে কান্দা খানেপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবনে ভোর বেলা উচ্চ বিদ্যালয়ের কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এই ভালো কাজেও কিছু লোকের ষড়যন্ত্র থেমে থাকেনি। বিদ্যালয়ে যাদের জমি দেয়ার কথা ছিলো, কিন্তু পরে তারা তা দিতে নারাজ। তৎকালীন চেয়ারম্যানও বিরোধিতা করতে থাকে। ১৯৮৪ সালে চেয়ারম্যানের লোকজন প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে উচ্চ বিদ্যালয়ের বেঞ্চ, টেবিল, চেয়ার সহ সকল আসবাবপত্র বাইরে ফেলে দেয়। তাড়িয়ে দেয়া হয় শিক্ষার্থীদেরও। ২য় বারের মতোও ব্যর্থ হলেও অদম্য ইচ্ছাশক্তি ছিলো আনিস মাস্টারের। চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকেন তিন। হঠাৎ ১৯৮৬ সালে স্ট্রোক করে মৃত্যুবরণ করেন তৎকালীন চেয়ারম্যান। তখন আনিছ মাস্টারের ভাই সিরাজ কাজল উপ নির্বাচনে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হোন। সময় আসে বিদ্যালয়টির পুনঃপ্রতিষ্ঠার। চেয়ারম্যানের সহযোগীতায় সাবেক মন্ত্রী আতাউদ্দিন খানের অর্থায়নে আনিছ মাস্টার আবার কার্যক্রম শুরু করেন বিদ্যালয়ের। তবে এবার বিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘খানেপুর উচ্চ বিদ্যালয়’। বিদ্যালয় হিসেবে স্বীকৃতি পায় ১৯৯৪ সালে, এবং ১৯৯৬ সাল থেকে নিজ বিদ্যালয়ের নামে শিক্ষার্থীরা এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিতে থাকে। তারপরও একদল ষড়যন্ত্রকারী নিয়মিত ষড়যন্ত্র করে যেতে থাকে বিদ্যালয়ের বিরোধিতা করে। এক পর্যায়ে হামলাও চালায় বিদ্যালয়ের সাথে জড়িতদের উপর। সব বাধা অতিক্রম করে ২০০১ সালে এমপিও ভুক্ত হয় খানেপুর উচ্চ বিদ্যালয়। বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করতে আনিস মাস্টার নিজ জমি দান সহ খাস জমি পত্তন এনেও স্কুলে দান করেছে। অনেক চড়াই-উতরাই শেষ করে অবশেষে আনিস মাস্টার প্রতিষ্ঠিত করেছেন ‘খানেপুর উচ্চ বিদ্যালয়’।
আনিস মাস্টার এলাকার উন্নয়নেও রেখেছেন অনেক অবদান। খানেপুর এলাকায় কোন বাজার ছিলো না, আনিস মাস্টার এলাকার মানুষদের সাথে নিয়ে খানেপুর বাজার বসানোর উদ্যোগ নেন। চালু হয় খানেপুর বাজার। যা আজও চলছে খানেপুর বাজার নামে। সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে বাজারটিও এখন বড় রুপ ধারন করেছে। খানেপুরে কোন ডাকঘর ছিলো না, যথাসময়ে চিঠি আদান প্রদান করা সম্ভব হতো না সেসময়। আনিছ মাস্টার উদ্যোগ নেন ডাকঘর প্রতিষ্ঠার। এখানেও অনেক চড়াই-উতরাই পার করে স্থাপিত হয় “খানেপুর বাজার” নামে ডাকঘর। যেটি প্রথম উদ্বোধন করা হয়েছিলো আনিছ মাস্টারের নিজ ঘরের বারান্দায়। পরবর্তীতে তা স্থানান্তর করা হয়। তার সকল কাজে যিনি ছায়ার মতো তার সাথে ছিলেন তিনি তার সহধর্মিণী বেগম কামরুন্নাহার। খানেপুর বাসী আজও মরহুম আনিছ মাস্টারকে শ্রদ্ধা ভরে স্মরন করে। তার ভালো কর্মই তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে মানুষের মনে ও ভালোবাসায়।